বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, পৃথিবীর কোনো দেশে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে আর্থিক খাতের সর্বনাশ কোথাও হয়নি। পৃথিবীর নানা দেশে আমি কাজ করেছি আইন ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে। হ্যাঁ, দুর্বল ব্যাংক ব্যবস্থাপনা হয়, মূল্যস্ফীতি হয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যাংক লুট করার ঘটনা একমাত্র বাংলাদেশে হয়েছে। শুধু একটি নয়, সাতটি ব্যাংক। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংকগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে, অর্থপাচার করা হয়েছে।’
রবিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) বেলা ১১টায় নীলফামারী সরকারি কলেজের হলরুমে আয়োজিত ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ রূপরেখা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়ার সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামান। সভায় কলেজের শিক্ষক, ব্যাংক কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন এবং তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর।
গভর্নর বলেন, আপনারা জানেন একটা পরিবার তাদের হাতেই ছিল সাতটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেটা আইনবহির্ভূত। আইন অনুযায়ী একটা পরিবার থেকে একটা ব্যাংকের শেয়ার ১০ পার্সেন্ট তার বেশি নয়। তাহলে কীভাবে তারা পুরোপুরি ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিল এবং ইসলামী ব্যাংকের ৮০ পার্সেন্টের ওপর শেয়ার হচ্ছে এস আলম গ্রুপের একটা পরিবারের। কীভাবে তারা পেলো?
এটা পুরোপুরিভাবে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা হয়েছিল পলিটিক্যাল ডাইরেক্টর।
ব্যাংকগুলোর ঘুরে দাঁড়ানোর বিষয়ে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, কিছু ব্যাংক আছে যেগুলো ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এদের মধ্যে ইসলামী ব্যাংক অন্যতম। তারা জানে যে ব্যাংকটা ভালো ছিল। ব্যাংকটা ভালো হতে পারে এবং ব্যাংকটা ভালো হবে। এই যে আস্থা এই আস্থাটা কিন্তু আমাদের ব্যাংকিং খাতের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ব্যাংকিং খাতের জন্য যদি আস্থাটা দিতে পারি তাহলে সকল ব্যাংকের ঘুরে দাঁড়ানো সহজ হবে।
তিনি আরও বলেন, মার্কেট যেভাবেই তৈরি হোক। আমরা প্রত্যেকটা ডিপোজিটারের অর্থ আমরা ফেরত দেবো। এই গ্যারান্টিটা আমরা দিচ্ছি। ডিপোজিটের কোনো টাকা হারাবে না। হয়তো সাময়িকভাবে তারা অ্যাক্সেস পাবেন না। কিন্তু যখন আমাদের প্রক্রিয়া শেষ হবে, তখন তাদেরকে অল্টারনেট একটা অ্যাসেট দেওয়া হবে। ইনশাআল্লাহ আপনাদের ক্ষতি হবে না। তাই আমরা ব্যাংকগুলোকে এমনভাবে পুনর্গঠন করব, এমনভাবে ম্যানেজমেন্টে নিয়ে আসব যাতে শক্তিশালী ব্যাংক হিসেবে তারা দাঁড়িয়ে যেতে পারে। ব্যাংক ঘুরে দাঁড়ানোর সময় লাগে না। চার পাঁচ বছর সময় লাগে। আমরা আশা করি, পরবর্তী সরকার সেটিকে সামনের দিকে নিয়ে যাবে। সামনের দিকে যদি তা নিতে পারে তাহলে কিন্তু এটা গঠনমূলক হবে না। কাজেই দায়িত্বটা কিন্তু পরবর্তী সরকারের।
পাচার হওয়া অর্থ ফেরতে আনার বিষয়ে গভর্নর বলেন, যে লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে তা উদ্ধারের চেষ্টা করছি। আমরা এখানে অনেকগুলো জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশন টিম গঠন করেছি। আর তারা প্রত্যেকে ব্যক্তিগতভাবে তথ্য নিচ্ছে। তারা অন্যান্য জায়গা থেকে তথ্য নিচ্ছে। তাদের কিছু সম্পদ, সম্পত্তি যেগুলো বাংলাদেশে আছে সেগুলোকে অ্যাটাচ করা হচ্ছে। ‘স্টোল অ্যাসেট ট্রেসিং’ এগুলোর জন্য বিদেশি কিছু সংস্থা আছে। সরকারি সংস্থা ইংল্যান্ডে আছে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন আছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আছে, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকেও আছে। আমরা এদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। তাদের কাছ থেকে আমরা কারিগরি সহায়তা দিচ্ছি। আইনগত সহায়তাও নিচ্ছি। আমরা চেষ্টা করছি ইনভেস্টিগেশনগুলোকে সঠিকভাবে করতে। কারণ এগুলো ইন্টারন্যাশনাল কোর্টে যখন আমরা নিয়ে যাব তখন এটা বাংলাদেশের কোর্টের স্ট্যান্ডার্ডের জন্য আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন তদন্তের ভিত্তিতেই তাদের সম্পদ আমরা জব্দ করতে পারব এবং পরবর্তীতে ফেরত আনতে পারব।
তিনি আরও বলেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে চার থেকে পাঁচ বছর লেগে যায়। এর মধ্যে আমরা মালয়েশিয়াতে দেখেছি চার থেকে পাঁচ বছর লেগেছে। আমরা দেখেছি নাইজেরিয়াতে সাবেক প্রেসিডেন্ট সম্পদ নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই টাকা ফেরত আনা হয়েছে, যা প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলারের মতো। এটা করা সম্ভব। তবে সময় লাগবে এবং এই সরকারের পক্ষে কিন্তু রেজাল্টটা দেখা সম্ভব নয়। শুরুটা করা সম্ভব, আমরা শুরু করে দেয়। কিন্তু শেষটা করতে হবে পরবর্তী সরকারকে।