ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের (মসিক) ব্যাংকে রাখা টাকার সুদের ১০ কোটি টাকা অনিয়মের মাধ্যমে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মেয়র মো. ইকরামুল হক টিটু পকেটে ভরেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের (বিসিবিএল) অভ্যন্তরীণ পরিদর্শন দলের অডিটে এই অনিয়মের তথ্য উঠে আসে বলে জানা গেছে।
রোববার (২ ফেব্রুয়ারি) ময়মনসিংহ বিসিবিএল ব্যাংক শাখার অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. আনোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, আমি কিছু দিন আগে এই শাখায় যোগদান করেছি। এর আগে যারা দায়িত্বে ছিল তাদের সময়ে এই লেনদেন হয়েছে। সম্প্রতি ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ অডিটে বিষয়টির সত্যতা মিলেছে। এরপরই বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন, এনবিআর এবং বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
পরিদর্শন প্রতিবেদনের তথ্য সূত্রে জানা যায়, ময়মনসিংহ বিসিবিএল ব্যাংক শাখার গ্রাহক ছিলেন ডেভেলপমেন্ট অব রোড অ্যান্ড ড্রেইনেজ নেটওয়ার্ক উইথ সিটিজেন সার্ভিস অব ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশন। এই শাখায় সিটি কর্পোরেশন উন্নয়ন তহবিল থেকে বিভিন্ন সময় প্রায় ৬৯২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা জমা করা হয়। এই জমা টাকার ওপর ৪ শতাংশ হারে সুদ ধরা হয়, যা মেয়রের মৌখিক চুক্তির ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ব্যাংকে জমা টাকার বিপরীতে সুদ-আয় ব্যাংকিং চ্যানেলে পরিশোধ করা হয়নি। সুদের অর্থ একাধিক পে-অর্ডারের মাধ্যমে সিটি করপোরেশনের নামে দেওয়া হয়। তবে এসব পে-অর্ডার সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা না করে মেয়রের নির্দেশে পে-অর্ডারগুলোর অর্থ ব্যাংকের শাখার কাউন্টার থেকে নগদায়ন করা হয়েছে। এরপর নগদায়ন করা টাকা একটি তৃতীয় পক্ষ মেসার্স কর্ণফুলী এন্টারপ্রাইজের অ্যাকাউন্টে জমা করা হয়, যার পরিমাণ ৭ কোটি ৫২ লাখ টাকা। এ ছাড়া অজ্ঞাত ব্যক্তির মাধ্যমে তুলে নেওয়া হয় ১ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। তাছাড়া ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর থেকে গত নভেম্বর মাসে একইভাবে আরও ১ কোটি ২৩ লাখ টাকা জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব জমা টাকার বিপরীতে যে পরিমাণ সুদ পরিশোধ করা হয়েছে তার বিপরীতে ট্যাক্স কাটা হয়নি। দেওয়া হয়নি সরকারি কোষাগারে ট্যাক্স জমা। এতে আর্থিক অস্বচ্ছতা সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি সুদ থেকে আসা আয় থেকে সরকারের কর ফাঁকি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
সিটি কর্পোরেশনের একটি সূত্র জানায়, সিটি কর্পোরেশনের একটি প্রকল্পের টাকা ওই ব্যাংকে জমা রাখা হয়েছিল। ওই সময় চলতি হিসাবের বিপরীতে ব্যাংকের বোর্ড সুদ দিতে রাজি হয়। ফলে সেই হিসাব নম্বর থেকে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের ঠিকাদারদের বিল পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু ওই জমানো টাকার সুদ-আয়ের বেশির ভাগ পে-অর্ডার ব্যাংকে জমা না দিয়ে নগদায়ন করে তুলে নেওয়া হয়েছে। এই হিসাব থেকে কর্ণফুলীর অ্যাকাউন্টে যে টাকা গেছে সেটাও তুলে নেওয়া হয়। আর এসব টাকাই মেয়র তুলে নিয়েছেন।
ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি কর্পোরেশনের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এবং বর্তমানে ময়মনসিংহের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মো. ইউসুফ আলী বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। এই বিষয়ে মেয়র, বর্তমান প্রধান নির্বাহী এবং প্রধান হিবাবরক্ষণ কর্মকর্তা ভালো বলতে পারবেন।
তবে কর্পোরেশনের বর্তমান দায়িত্বরত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম মিঞা বলেন, অ্যাকাউন্টটি খুলেছেন প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা। এ বিষয়ে তারাই ভালো বলতে পারবে।
বিষয়টি নিয়ে একই সুরে কথা বলেছেন মসিকের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা অসীম কুমার সাহা। তিনি বলেন, যৌথ অ্যাকাউন্টে এই লেনদেন পরিচালিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী এবং মেয়র যৌথভাবে এই অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করেছেন। তবে আমার জানামতে, এটি চলতি হিসাব। চলতি হিসাবে সুদ হয় না। যদি হয়, তবে সিটি কর্পোরেশন লাভবান হবে।
সিটি কর্পোরেশনের অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার মো. মোকতার হোসেন বলেন, ঘটনাটি আমি শুনেছি। জেনেছি টাকাগুলো তারা এক অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করেছে। তবে ঘটনার গভীরে খোঁজ নিলে বিষয়টির বিস্তারিত জানা যাবে।
তবে এ বিষয়ে সাবেক মেয়র মো. ইকরামুল হক টিটুর বক্তব্য জানা যায়নি। গত ৫ আগস্টের পর তিনি ভারতে পালিয়ে গেছেন। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা চলমান। ফলে পুলিশের খাতায় তিনি পলাতক বলে দাবি একটি সূত্রের।