অধঃপতনের শেষ স্টপেজে গিয়েও এখন পর্যন্ত ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ নেই ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের। ক্ষমা চাওয়া না হোক, ভুল স্বীকারের ধারেকাছেও নেই। দলে সংস্কারের তো শব্দই নেই। বরং যা করেছে, সব ঠিক করেছে; সুযোগ পেলে ভবিষ্যতে আরও করবে বলে মতিগতি। তারপর আচানক যত গুজবের হাটবাজার খুলে দেউলিয়াত্বের ষোলোকলা পূরণ করে চলছে।
সর্বশেষ গুজবে জানানো হয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে নেত্রীর কথা হয়ে গেছে। আলাপ হয়েছে অনেকক্ষণ। এবার সত্যি সত্যিই তিনি যে কোনো সময় মুভ করবেন। চলে আসবেন চট করে। মোদি ও অমিত শাহ ছাড়াও ভারতীয় কূটনীতিকরা মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে ফাইনাল কথা বলে ফেলেছেন। নেতাকর্মীরা যেন বুকে ট্রাম্প ও হাসিনার ছবি ঝুলিয়ে ঢাকা আসার প্রস্তুতি নেয়।
দু-তিনদিন আগের গুজবের আপডেট ছিল- ডক্টর ইউনূস সরকার পালিয়ে গেছেন। ফেসবুকে এই পোস্ট দেখে নোয়াখালীতে আনন্দ মিছিল করতে গিয়ে যুবলীগের দুই নেতা গ্রেপ্তারও হয়েছেন। কী অবাক-আচানক কাণ্ড। নিজেদের কৃতকর্মের কোনো অনুশোচনা নেই। কিন্তু আকাশকুসুম কল্পনায় ঠাসা মন-মগজ। বড় মাপের লুটেরা-মাফিয়ারা বিদেশে মোজমাস্তিতে মশগুল থেকে দেশে কোনো মতে বেঁচে থাকা আবেগি কর্মীদের এসব ট্যাবলেট গেলাচ্ছেন। তারাও কম-বেশি গিলছেন। এসব কর্মী দলের ক্ষমতার ১৫-১৬ বছরে নেতাকে সালাম দিয়ে তার উত্তর পায়নি, নেতার বাসায় গিয়ে বসার সুযোগ পায়নি। আর্থিক সুবিধাও তেমন হাসিল হয়নি। বিদেশ থেকে নানা ধরনের উদ্ভট তথ্য দিয়ে এসব কর্মীকে বিভ্রান্ত করে একটা হাইপ তুলে তাদের বিপদে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে একেবারে নোংরা চিন্তায়।
এত বড় প্রাচীন একটা দল কীভাবে হাওয়ায় মিশে গেল, সেই কারণটাও অনুধাবনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না কর্মীদের। এর আগে, ভারতীয় সহায়তায় ছড়ানো হয়েছে- বাংলাদেশের সংখ্যালঘু, মন্দির, মাজার, পাহাড়, সমতল নিয়ে নানা কুসংবাদ।
ভারতের কিছু গণমাধ্যম এ কাজে যারপরনাই খেটেছে। এখনো খাটছে। একটা না একটায় বিশৃঙ্খলা বাধানোর অপচেষ্টায় এবার সেনাবাহিনীরও পিছু নিয়েছে। প্রোপাগান্ডা মেশিন আনন্দবাজারকে দিয়ে সাজানো হয়েছে ‘উর্দিতে বাঙালি গণহত্যার রক্তের ছিটে! ৫৩ বছর পর বাংলাদেশে ফিরছে সেই পরাজিত পাক ফৌজ’ শিরোনাম। আনন্দবাজার পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত এ শিরোনামের প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষক দল আসার গুজব রটানো হয়েছে। যার সঙ্গে বাস্তবতার লেশমাত্র নেই। ৫ আগস্টের পর থেকে ইন্ডিয়া টুডে, আনন্দবাজার পত্রিকাসহ ভারতীয় কয়েকটি সংবাদমাধ্যম এজেন্ডা নিয়ে বাংলাদেশে বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করছে আদাজল খেয়ে। ‘গদি মিডিয়া’ নামে প্রচারিত ভারতের উগ্র ডানপন্থি শাসক দল বিজেপির স্বার্থ রক্ষাকারী গণমাধ্যমগুলো ড্যাম কেয়ারেই এ কর্ম করে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে উত্তেজনা বা শোরগোল তৈরি করতে পারলেও বড় রকমের অঘটন ঘটাতে না পেরে তারা এখন টার্গেট করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে। তা এরইমধ্যে ব্যর্থ হয়েছে। এসব করে নিজেই নিজেকে ছোট করে আনছে ভারত। আর আন্তর্জাতিক বিশ্ব তো দেখছেই। বলার অপেক্ষা রাখছে না, শেখ হাসিনার ভালোর জন্য যা করা দরকার, ভারত সবই করবে। রাজনীতি-কূটনীতি না জানা মানুষও তা বোঝে। কিন্তু ভারত তা করতে গিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে মারাত্মকভাবে ভারতবিদ্বেষী করে তুলছে। আবার ঐক্যবদ্ধও করছে।
সেইসঙ্গে আওয়ামী লীগের বাকি সর্বনাশও করে ছাড়ছে। যার টাটকা উদাহরণ নিয়মিত দেখা যাচ্ছে সীমান্ত এলাকাগুলোতে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১৯৮১-তে শেখ হাসিনার আগমন ভারত থেকে। ২০২৪ সালে নির্গমন ভারতেই। যেখান থেকে এসেছেন সেখানেই গেছেন। তার অকৃত্রিম ভরসাস্থল ভারত। যা তিনি গোপন রাখেননি। ক্ষমতায় থাকতে ঘটনাচক্রে নিজ মুখেই বলেছেন, ‘ভারতকে যা দিয়েছি তা তাদের আজীবন মনে রাখতে হবে’। অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণ, ভারত তা মনে রেখে চলছে। কৃতজ্ঞতার স্মারক হিসেবে কেবল ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি নয়, কংগ্রেসসহ ভারতের সব কটি দল সিদ্ধান্ত নিয়েই তাকে আশ্রয় দিয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট ভারতে চলে যাওয়ার পর দেশটির ক্ষমতাসীন দল বিজেপি ও বিরোধী দল কংগ্রেসসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সংসদের ভেতরে-বাইরে দফায় দফায় বৈঠকে বসে। তার কল্যাণে যা দরকার সবই করার নীতিগত সিদ্ধান্ত তারা নিয়েই রেখেছে। কিন্তু, সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়নে গুজব, মিথ্যাচার, প্রোপাগান্ডার কদাকার পথ মোটেই কূটনীতির স্মার্টনেসের প্রমাণ দেয় না।
অব্যাহত এ নোংরামি, বিশ্বের সুপার পাওয়ার হতে আগ্রহী, চাণক্য কূটনীতির দেশটির জন্য এক ধরনের পরাজয়। কূটনৈতিক শালীনতার বিচারে ৫ আগস্টের পরাজয়ের চেয়ে এ পরাজয়ও কম নয়। নামতে নামতে কত নিচে নামা যায়, সেই নজির তৈরি করতেও বাধছে না ভারতের। ভারতে সন্ত্রাস ছড়াতে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ বোঝাই পাকিস্তানি বিস্ফোরক আনার খবর রটাতেও শরম লাগছে না ভারতীয় পত্রিকার। শেখ হাসিনাসহ বিগত শাসকদের হত্যা, গণহত্যা, অর্থ পাচারসহ নানা দুর্নীতির বিচার প্রক্রিয়া যত এগোচ্ছে দেশটির প্রোপাগান্ডা মেশিনকে আরও শাণিত করা হচ্ছে। আলামত বলছে, বাংলাদেশের দিকে তাক করা ভারতের এ মেশিন সামনে আরও বহু অপপ্রচার চালাবে। দায়িত্বের মতো বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর ‘কল্পিত ক্র্যাকডাউনের’ গল্প প্রতিনিয়ত আবিষ্কার করতেই থাকবে। সেনাবাহিনীকে নিয়ে মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর কেচ্ছা রটাতেই থাকবে।
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে দেশের সব জাতিগোষ্ঠী, ধর্ম, সামাজিক ও রাজনৈতিক মতামতের মানুষ এক হয়ে রাস্তায় নেমেছে। এতে শেখ হাসিনা এক কাপড়ে ভারত পালাতে বাধ্য হন। ভারতের জন্য এটি কষ্টের, লজ্জার। সেই লজ্জায় মুখ ঢেকে হলেও রিয়্যালিটির ঝড় ভারতের ভোলার মতো নয়। একাত্তরে পাকিস্তানিরা রিয়্যালিটি মেনে নেয়নি। পরিণামে ভুগেছে। গত কয়েক বছর ধরে রিয়্যালিটি মানছে না বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারত। চারদিকের প্রতিবেশীদের জ্বালিয়ে অতিষ্ঠ করে তুলছে। শেষতক কুলাতে পারছে না। আবার হালও ছাড়ছে না, দমছে না। উগ্রবাদের গোঁয়ার্তুমিতে ঠেলছে-ধাক্কাচ্ছে। একনায়কত্বের দর্প এভাবেই গুঁড়িয়ে যায়। তা নির্দিষ্ট কোনো দেশে নয়। সিরিয়া, শ্রীলঙ্কা আর বাংলাদেশ সবখানেই। জাগতিক এই রীতি অতি প্রাচীন। নতুন এক বাংলাদেশ মানতেই পারছে না ভারত। গণআন্দোলনের তোড়ে গদিচ্যুত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে ভারত পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার হেন চেষ্টা নেই যা না করছে। অথচ দলটিকে রাজনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করছে না।
জনগণের পরিবর্তে কেবল একটি দল ও দলনেতার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার ভারতীয় এ কূটনীতি কেবল বুমেরাং হচ্ছে না, দেশটি বিশ্ব দরবারে নিম্নরুচির হিসেবে চিহ্নিতও হচ্ছে। আবার, বাংলাদেশে আধিপত্যবাদী শক্তিকে মোকাবিলায় এখন সামরিক এবং বেসামরিক শক্তির শক্ত সেতুবন্ধ দিন দিন মজবুত হচ্ছে। যে তাগিদ মাসকয়েক আগেও ছিল না। অবিরাম তিক্ততায় সম্পর্ক মেরামতের জায়গাও নষ্ট করে দিয়েছে ভারতই। দেশের সঙ্গে সম্পর্কের বদলে তারা সম্পর্ক গড়েছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে, শেখ হাসিনার সঙ্গে। এ থেকে তাদের এখন পর্যন্ত সরে আসার আলামত নেই। যে কারণে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক সামনের দিনগুলাতে আরও তিক্ত হওয়ার সমূহ শঙ্কা ভর করেছে। আগরতলায় বাংলাদেশের হাই কমিশনে হামলা, লুট পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে বাংলাদেশ ও ভারতের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের বাগ্যুদ্ধ ক্রমান্বয়ে উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে। চিকিৎসাসেবা ও সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ থেকে শুরু করে দুই দেশে পতাকা পোড়ানো বা পদদলিত করা, বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতি, ভিসা বন্ধ বা সীমিত করার ঘটনাসহ সাম্প্রতিক অস্থিরতা বাজে ইঙ্গিত দিচ্ছে। ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য ও ভারতের ব্ল্যাঙ্ক চেকে শেখ হাসিনা বরাবরই মুখে যা আসে তা বলে অভ্যস্ত। মন যা চেয়েছে করেছেন। এখন আর করতে পারছেন না। এই জেদে-ক্ষোভে এত কথা বলতে হবে? তা-ও লেখার অযোগ্য, শোনার অনুপযুক্ত ভাষায়? চট করে চলে আসবেন বলে কিছু কর্মীকে মাঠে নামিয়ে ছেঁচা মার খাইয়েছেন। নেতারা বেশ শেয়ানা। একজনও মাঠে নামেননি। শিগগিরই নামার নমুনাও নেই। বাবা-কন্যার বদলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবিযুক্ত ব্যানার-পোস্টার নিয়ে ধরা পড়া আবেগিরা কেবলই পরিস্থিতির শিকার। ইতিহাসের কালো দিন ১৫ আগস্টের পর ১০ নভেম্বর নূর হোসেন দিবসেও একই কুচর্চা হয়েছে। অডিওতে শোনা, ‘ট্রাম্পের ছবি নিয়ে মিছিল করবা, সেই ছবি ভাঙচুর হবে, তার ছবি তুলে আমাকে পাঠাবা, আমি তা ট্রাম্পের কাছে পাঠাব। তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে।’
ভ্রষ্ট চিন্তায় এ দেউলিয়াপনায় ১০ নভেম্বর নূর হোসেন দিবসে ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ ইত্যাদি লীগকে রাজধানীর জিরো পয়েন্টে জমায়েত হওয়ার ভার্চুয়াল বার্তা দিয়ে অ্যাকচুয়ালে নেতাদের কেউ এলেন না। ধারেকাছেও না থাকার নিষ্ঠুর তামাশা। জনাকয়েক কর্মীকে ঠেলে দেওয়া হলো এ সময়ের বাঘ-সিংহদের মুখে। এর আগের রাতে শেখ হাসিনার ভাইরাল হওয়া কথিত অডিও ক্লিপের নির্দেশনা বাস্তবায়নকারী ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ-ডিএমপি। তারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি ও যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা ব্যবহার করে মিছিলে ভাঙচুর ও অবমাননার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছিলেন। ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের ধরা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে বিপুল উসকানিমূলক পোস্টার, ছবিসহ প্ল্যাকার্ড ও নগদ অর্থ জব্দ করা হয়। সম্প্রতি ভাইরাল অডিও বার্তায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দেশকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে দলের নেতাকর্মীদের যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি ও যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা ব্যবহার করে মিছিল-সমাবেশের নির্দেশদৃষ্টেই তারা এই দুঃসাহস করেছেন। ভার্চুয়াল জগতে দিনরাত সমানে নানা উল্টাপাল্টা মেসেজ ছোড়া এখন আওয়ামী লীগের বিশেষ এজেন্ডা। করুণ-লজ্জাজনক পতনের পরও সাধারণ মানুষের এ সময়ের সেন্টিমেন্ট না বুঝে উল্টো পথে নামিয়ে আবেগি-নিরীহ কর্মীদের সঙ্গে নির্মমতা। নিজের দুই কান কাটার পর, পরের যাত্রাভঙ্গ করার এই অপরিণামদর্শী তৎপরতা আওয়ামী লীগকে আরও কত ভোগাবে- তা বুঝতে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে না।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন